রংপুরে গোসলের ভিডিও ধারণ, গৃহবধুকে ধর্ষণ-অর্থ আদায়, মিমাংসার জন্য পুলিশের চাপ
থানা পুলিশ ৩-৪ দিন ধরে ঘুরছে আর আপোষ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। গরীব হওয়ার কারণে কি ওই গৃহবধু বিচার পাবে না।
এহসানুল হক সুমন ♦ রংপুরে গোসলের অর্ধনগ্ন ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে এক গৃহবধুকে একাধিকবার ধর্ষণ ও মোটা অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে বখাটে আরিফুল ইসলামের (২৫) বিরুদ্ধে। এ ঘটনাটি ঘটেছে নগরীর বাহার কাছনা এলাকায়। ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ও স্থানীয় মাতব্বররা ম্যানেজ হয়ে প্রভাবশালী আরিফুলের পরিবারের পক্ষ নিয়েছে। থানায় ওই গৃহবধুর ধর্ষণের মামলা নিতে পুলিশ গড়িমসি করে উল্টো আরিফুলের পরিবারের করা মারপিটের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে ওই গৃহবধুসহ পরিবারের লোকজন বখাটে আরিফুলের পরিবারের হুমকিতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভ‚গছে। এদিকে ফোনে নগ্নভিডিও ধারণ ও জিম্মি করে ধর্ষণের ঘটনাটি জানাজানি হলে আরিফুলসহ পরিবারের লোকজন গা-ঢাকা দিয়েছে।
মামলা এজাহার, ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, গত এপ্রিল মাসে রংপুর নগরীর বাহার কাছনা এলাকার এক দিনমজুরের গৃহবধু’র (২০) গোসলের সময় টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অর্ধনগ্ন ভিডিও ধারণ করে পার্শ্ববতী আব্দুর রাজ্জাকের বখাটে ছেলে আরিফুল। এরপর সেই গোসলের ভিডিও দেখিয়ে আরিফুল ওই গৃহবধুর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে। টাকা না দিলে ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি দেয় সে। নিজ সংসার বাঁচাতে ওই গৃহবধু বিষয়টি গোপন রেখে জমি কেনার জন্য সঞ্চিত ৪০ হাজার টাকা আরিফুলকে দেয় এবং ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে না দিতে অনুরোধ করে। এর কিছুদিন পর আবার আরিফুল ওই গৃহবধুকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ৬০ হাজার টাকা নেয়। গত ৯ এপ্রিল রাতে ওই গৃহবধুর স্বামীর অনুপস্থিতিতে আরিফুল বাড়িতে ঢুকে আরও ১০ হাজার টাকা দাবী করে এবং ওই সময় চিৎকার করলে ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়। ওই গৃহবধু আরিফুলের পা ধরে অনুরোধ করে এবং তার কাছে আর কোন টাকা নেই বলে জানায়। এ সময় আরিফুল ওই গৃহবধুকে ঘরে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরদিন একইভাবে আরিফুল ওই গৃহবধুর বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ভিডিও ফোনে ধারণ করে। আরিফুল তার কয়েকজন বন্ধুকে ধারণ করা অর্ধনগ্ন ও ধর্ষণের ভিডিওটি সরবরাহ করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর ওই গৃহবধু বিষয়টি তার পরিবারের লোকজনকে জানায়। এরই মধ্যে আরিফুলের পরিবারের লোকজন তাদের বাড়িতে বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য গৃহবধুর পরিবারকে ডাকে। ২৫ মে রাত ১০টায় ওই গৃহবধুর স্বামী, ভাসুরসহ পরিবারের অন্যান্যরা আরিফুলদের বাড়িতে গেলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বাক-বিতন্ড এবং মারামারির ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় ওই গৃহবধুর ভাসুরের বাম হাত ছোরা লেগে কেটে যায়। এ সময় স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে তাদের ভয়-ভীতি দেখায় আরিফুলের পরিবার। এ ঘটনায় পুলিশকে ম্যানেজ করে আরিফুলের পরিবার মিথ্যা হামলার নাটক সাজিয়ে উল্টো ওই গৃহবধুর পরিবারের নামে থানায় মামলা দায়ের করে। কিন্তু ওই গৃহবধুর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় একাধিকবার গেলেও গৃহবধুর অভিযোগ গ্রহণ না করে আরিফুলের পরিবারের সাথে মিমাংসা করার চাপ প্রয়োগ করে থানা পুলিশ এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ২৫ মে’র পর থেকে আরিফুলের বাড়ির সামনে থেকে ওই পরিবারের যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দেয় আরিফুলের পরিবার। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ওই ভুক্তভোগী পরিবার। পরে স্থানীয় অধিবাসীদের জোরালো প্রতিবাদে তোপের মুখে রোববার সন্ধ্যায় রাস্তাটি উন্মুক্ত করে দেয় আরিফুলের পরিবার। নগ্ন ভিডিও ধারণ ও জিম্মি করে ধর্ষণের ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে গা-ঢাকা দেয় আরিফুল ও পরিবারের সদস্যরা।
রোববার সন্ধ্যায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রভাবশালী ওই পরিবারের অব্যহত হুমকির কারণে পার্শ্ববতী বাড়ির পেছনের একটি সরু গলি দিয়ে যাতায়াত করছে ভুক্তভোগী পরিবার। আরিফুলদের বাড়ি সামনে হওয়ায় তারা জোরপূর্বক যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে সাংবাদিক আসার খবরে রাস্তাটি উন্মুক্ত করে দেয় তারা। ওই গৃহবধুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রভাবশালী আরিফুলের বাড়ি তাদের বাড়ি লাগোয়া হওয়ায় হুমকির কারণে ভয়ে, জীবননাশের আশংঙ্কায় দিন পার করছে পরিবারটি। ভুক্তভোগীর স্বামী ঢাকায় রিক্সা চালায় এবং এক দেড়মাস পর পর বাড়িতে আসা-যাওয়া করার কারণে আরিফুল সুযোগ বুঝে অর্ধনগ্ন ভিডিও ধারণসহ ওই গৃহবধুকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ করেন পরিবারের সদস্যরা।
ওই গৃহবধুর ভাসুর বলেন, আরিফুলের বাবা তাদের বাড়িতে মিমাংসার জন্য ডাকলে আমরা যাই। তাদের বাড়িতে আগে থেকে দা-ছোরা দিয়ে তারা প্রস্তুত ছিল। আমরা যাওয়ার পর আমাদের উপর হামলা চালায় আরিফুল, আরিফুলের বাবা আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), চাচা রেজাউল ইসলাম (৪০), ইসলামুল হক (২৫)। আমাকে আঘাত করলে আমি হাত দিয়ে ছোরার আঘাত প্রতিহত করি। এতে আমার হাতও কেটে যায়। এ ঘটনার পর আমরা থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ টালবাহানা শুরু করে এবং ঘটনাটি মিমাংসার জন্য বলে। এখন আরিফুলের পরিবার আমাদের নিয়মিত হুমকি দিচ্ছে। আমরা চরম নিরাপত্তা হীনতায় ভ‚গছি। তারা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশসহ সবাই তাদের পক্ষে। আমরা এখন বড় অসহায়।
ভুক্তভোগী ওই গৃহবধু বলেন, সহজ-সরলতার সুযোগ নিয়ে বখাটে আরিফুল আমার গোসলের ভিডিও ধারণ করে আমাকে হুমকি দিয়ে জমি কেনার জমানো এক লাখ টাকা নিয়েছে। আরও টাকা চায়। টাকা না দেয়ায় ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে দুইবার ধর্ষণ করেছে। এখন পুলিশ, মাতব্বর সবাই বলছে মিমাংসা করো। আমরা গরীব বলে কেউ আমাদের পাশে নেই। ধর্ষণের ঘটনা কি মিমাংসা করা যায়। দেশে যদি আইন থাকে তবে আমি অবশ্যই ধর্ষণের ন্যায্য বিচার পাবো। আমি আরিফুলের ফাঁসি চাই।
স্থানীয় এলাকাবাসী অজিহার আলী বলেন, আমরা এলাকাবাসী ওই গৃহবধুকে নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে। ওসি বলে আরিফুল ভিডিও করছে, ধর্ষণ করছে, মারামারি করছে এর প্রমাণ কি। পরে আমরা ভিডিও, আরিফুলের স্বীকারোক্তিমূলক কলরেকর্ড নিয়ে থানায় অভিযোগ করেছি। এরপর থেকে থানা পুলিশ ৩-৪ দিন ধরে ঘুরছে আর আপোষ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। গরীব হওয়ার কারণে কি ওই গৃহবধু বিচার পাবে না। কোর্ট-কাচারী কি শুধু বড়লোকের জন্য।
এ বিষয়ে আরিফুলের দাদা মাদ্রাসার দপ্তরী আফছার আলী বলেন, আমার নাতীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে তারা। বর্তমানে আমার নাতি পলাতক নয়, সে ঢাকায় চাকুরীর খোঁজে গিয়েছে।
এ বিষয়ে হারাগাছ থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, বিষয়টি তদন্তধীন রয়েছে। আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাটি দেখছেন। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।