বাবার স্মৃতিগুলো কে নিয়ে লিখলে কখনো শেষ হবে না
আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। দিনটি অনেকের কাছে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসলেও আমার কাছে নিয়ে আসে কষ্টের বার্তা ! এই দিনটিই আমার জীবনের সব থেকে কষ্টের দিন । কারণ আমার বাবা ২০১৬ সালের ৩০ শে রমজান সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হবার পর এই ঈদুল ফিতরের দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে যান । বাবা হারানোর পুরো পাঁচ বছর পূর্ণ হল আজ।
কারো কাছে মনে হতে পারে পাঁচ বছর অল্প সময় কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে কত বছর, কত যুগ থেকে বাবাকে দেখি না! কত বছর থেকে বাবার সঙ্গে কথা হয় না ! ঈদে মার্কেট যাই না ! ঈদেরর নামাজ পড়তে যাই না ! আড্ডা হয় না, ঘুরতে যাই না। মনের কথাগুলো বলতে পারি না। বাবার কথা বা স্মৃতি মনে পড়লেই বুকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, আর যখন ভাবি যে বুকের মধ্যের সেই ফাঁকাটা আর কোন দিনই পূর্ণ হবেনা, তখনকার কষ্ট/যন্ত্রণা যে কতটাই যে বিশাল তা বুঝাতে পারবো না । আসলে যারা পিতাহারা তারাই এটি বুঝতে পারবে !!
বাবা হারানোর কষ্ট অনেক নতুন নতুন কষ্টের সৃষ্টি করে কারণ ঈদ এলেই বাবা হারানোর ফলে মায়ের ও বোনের কষ্ট ও যন্ত্রণাগুলো দেখাও অনেক কষ্টের! বাবাকে হারানোর কষ্ট কি শুধুই হারানোর কষ্ট না এ কষ্টের গভীরতা অনেক বিশাল। বাবাকে নিয়ে লিখতে গেলে কখনেই শেষ হবে না, কারণ আমার সমস্ত স্মৃতির বেশীর ভাগ অংশই বাবাকে নিয়ে । আমার জীবনের প্রথম – শেষ এবং শ্রেষ্ঠ বন্ধু শুধুই বাবা।
বাবাকে ছাড়া পাঁচটি বছর পার হলো, ৯টি ঈদ চলে গেল; কিন্ত এত চেষ্টা করেও ঈদ এলেই বাবাকে আর বাবার সাথে ঈদের স্মৃতিগুলোকে ভুলে থাকতে পারি না। বাবাকে বলতে ইচ্ছে করে কেমন আছো তুমি? তুমি কি আমার, আম্মুর ও আপুর ডাক গুলো শুনতে পাও? আমাদের দোয়া, দান, সদকা এর সওয়াব গুলো কি তোমার কাছে পৌঁছায়?!
সেই ছোট্ট বেলা থেকেই বাবার সাথে ঈদ বাজার করা, ঈদগাহে যাওয়ার অভ্যাস। প্রায় ২০ বছরের স্মৃতি কি ভুলা যায়! এই বাঁধন যে রক্তের, এই বাঁধন যে পিতা ও পুত্রে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই ঈদগুলো এখন আর ভালো লাগে না, ঈদগুলো এখন আনন্দের বার্তা না নিয়ে আসে কষ্টের বার্তা নিয়ে! মনে আছে ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে আমাদের গ্রামের ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যাওয়া । আর কত কি সেই সময় বিশেষ করে চাঁদ রাতে আমি আর বাবা বের হতাম গেঞ্জি কিনতে। কিন্ত গেঞ্জি কেনা আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, মূল উদ্দেশ্য ছিল রংপুর জাহাজ কোম্পানির মোতাহার প্লাজায় গিয়ে কাবাব খাওয়া।
অন্য দিন ফজরের নামাজ না পড়লেও ঈদের দিন খুব সকালে উঠে বাবার সাথে ফজরের নামাজ আদায় করে রাস্তায় হাটতে বের হতাম। তারপর বাসায় এসে দেখতাম এক চুলায় রান্না হচ্ছে সেমাই আরেকে চুলায় গরম করা হচ্ছে পানি। কারণ আগের রোজার ঈদগুলি হতো শীতকালে। তাই গরম পানি দিয়ে গোসল করা হতো। বাবা গোসল করেই তাড়া দিত আমাকে গোসল করার জন্য। আমি গোসল শেষ করেই দেখতাম দুই বড় আব্বা ও জেঠাতো ভাই এসেছে। তারাসহ সকলে সেমাই খেয়ে আমার ছোট চাচা, চাচাতো ভাইসহ সকলে রওনা হতাম ঈদগা মাঠের দিকে।
ঈদগা মাঠে আমরা সকলে এক সাথে বসতাম। আমি বসতাম বাবার সাথে। ঈদের নামাজের পর বাবা, চাচা, বড় আব্বা চাচাতো ভাইয়া সকলে একসাথে দাদা – দাদীর কবর জিয়ারত করতাম। তারপর বাবা সকলকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে। খাওয়ার পর সকলে নানা হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতো, খুব সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরী হতো। ঈদের দিন বিকেলে বাবা আর আমি যেতাম আমার খালুর করব জিয়ারতে ।
তখনকার ঈদে কিনে দেয়া বাবার পাঞ্জাবিতে যে কতটা সুখ লুকায়িত ছিল তা আজ বুঝতে পারি। বাবা একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরী করতো, আমরা মোটামুটি ভালোভাবেই চলতাম। ২০ রমজানের পর বেতন ও বোনাস পেতো, তারপর আমরা ঈদের মার্কেট করতাম। বাবা তেমন কিছুই নিতো না। কিন্ত আম্মুর জোর করাতে মাঝে মাঝে নিতো। আর চাঁদ রাতে আমার জন্য একটি আলাদা বোনাস বরাদ্দ থাকতো । সরকারী চাকুরীর সুবাদে বাবাকে দেখেছি খুব নিয়ম শৃঙ্খলাময় জীবন যাপন করতে । সকালে ফজরের নামাজের পর হাটতে বের হতো এর পর বাসায় এসে নাস্তা করে অফিসে যেত, অফিস থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বিকেলে চেম্বারে বসতো। তারপর রাতে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তো । দিন রাত পরিশ্রম করতো আমাদের জন্য। নিজের সব শখ-সুখ বিসর্জন দিতো আমাদের জন্য।
বাবাকে নিয়ে বাবার স্মৃতিগুলো কে নিয়ে লিখলে কখনো শেষ হবে না । কতগুলোই বা লেখা যায় । বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে । গত পাঁচ বছরে কোন ঈদে আমাদের আর কিছু নেয়া হয়না ! আম্মুর দেয়া ঈদের খামটা পড়ে থাকে! এখন আর চাঁদ রাতে বাবার মতো বোনাস কেউ দেয় না! এখন আর চাঁদ রাতে কাবাব খেতে যাওয়া হয় না! এখন আর ফজরের নামাজ মসজিদে পড়া হয় না, বাসাতেই পড়ি! ঈদের দিন সকালের গোসলে আম্মু তাড়া দিলেও বাবার তাড়া দেয়াটা মিস করি ! ঈদের মাঠে এখন চাচাতো ভাইদের সাথে চলে যাই ! নামাজের পর চাচা আর চাচাতো ভাই দের সাথে পারিবারিক কবর জিয়ারত করি আর বাবার কবরটাতে তাকালেই বুকটা খা খা করে ! এখনো কবর জিয়ারতের পর চাচা ও চাচাতো ভাইরা বাসায় আসে। কিন্ত বাবা না থাকাতে সেই আগের মতো প্রাণবন্ত আলোচনা আর হাসি ঠাট্টা জমে না !
ঈদেরর দিন বিকেলে খালুর কবর জিয়ারতে ও আর যাওয়া হয় না ! ঈদের সময় বাবার সাথের সেই দিনগুলি খুব মিস করি ! বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে ! জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ! বলতে ইচ্ছে করে বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি না চলে গেলে বুঝতাম না যে তোমাকে এতটা ভালোবাসি । বাবা ছাড়া ঈদগুলি যেন ফ্যাকাসে মনে হয় ! বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের আর কোন ঈদ ভালো কাটে নাই ! জানি আর কোনদিনও ভালো কাটবে না। কারণ ঈদের দিনই যে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি ! বাবাকে আর না পাওয়ার বেদনা গুলোকে সাথী করে নিয়ে আমাদের একদিন চলে যেতে হবে। কারণ মৃত্যুর স্বাদ তো সকলকেই পেতেই হবে । তার পরও মনে পরবে প্রিয় বাবাকে। আজকের মতো বিশেষ কোন দিনে, দিবসে বা যখন একা থাকবো তখন ।
লিখতে আমার কখনো হাত কাঁপে না বা খারাপ লাগে না । কিন্ত বাবা সম্পর্কে কয়েকটা লাইন টাইপ করতে গিয়েও আমার হাত কাপে আর কান্না পায় ! কিন্তু এটা সত্য ভালবাসার প্রিয় মানুষকে হারানোর পর স্মৃতিগুলোকে বা হারানোর পরবতীঁ অভিজ্ঞতাকে লিখতে কাঁদতেই হবে ! ঈদ সকলের ভালো যাক। আর কিছু লিখতে চাই না নিজের কষ্ট আর বাস্তব অভিজ্ঞতার কিছু অংশ শেয়ার করলাম।
অবশেষে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমাকে জান্নাতুল ফিরদউস দান করেন। এবং এটাও দোয়া করি যেন পরকালে আল্লাহ্ আমাদের তোমার সাথে মিলিত করেন। পৃথিবীর সকল বাবারা সুখে থাক। আর যে সকল বাবারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের সকলকে আল্লাহ জান্নাত দান করুন। আমিন।
-মুন্তাসির পারভেজ অংকুর, বাহার কাছনা, রংপুর