প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়ের দাপটে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বেহাল অবস্থা

আদালতের দেয়া নির্দেশও অমান্য করছেন বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি

প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়ের দাপটে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বেহাল অবস্থা

স্টাফ রিপোর্টার ♦ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়, আওয়ামী লীগ নেতা কেএম ছায়াদত হোসেন বকুলের ক্ষমতার অপব্যবহারে শতবর্ষী রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে চলে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আদালতের রায়কে অমান্য করে সহকারী প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়ে নিজের আস্থা ভাজন শিক্ষককে  ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে নিজের খেয়াল-খুশি মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। এতে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। সেই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে হোটেল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কক্ষ ভাড়া দিয়ে অর্থলোটের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এনিয়ে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে বরখাস্তের ভয়ে বকুলের অনিয়মের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খুলছেন না বর্তমান শিক্ষকরা।   
জানা যায়, রংপুর সিটি বাজারের পার্শ্ববর্তী ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়। এক সময় রংপুর জেলার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ছিল এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেতে ভর্তি যুদ্ধে নামতে হতো শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের চাপ সামলাতে প্রতিটি ক্লাসে ৩ থেকে ৪টি করে শাখা ছিল। দীর্ঘ প্রায় একশ বছর অতীত ঐতিহ্য নিয়ে চলেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে গোটা দেশে আলো ছড়িয়েছে সাবেক শিক্ষার্থীরা। মানুষ গড়ার কারিগর সেই বিদ্যালয়টি এখন ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে। 
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরই সাবেক প্রধান শিক্ষক ইয়াসিন আলী অবসরে যান। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক থাকা স্বত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ভাসতি জামাই হওয়ার সুবাদে ধর্মীয় শিক্ষক প্রয়াত আবুল মুযন আজাদ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে নিজের খেয়াল খুশিমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমার সাথে শিক্ষার্থীর হার কমতে থাকে। বর্তমানে এ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১৩৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ২০২২  সালের ২ মার্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল মুযন আজাদ অবসর গ্রহণ করলে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অ্যাডহক কমিটির ৬ মাসের জন্য সভাপতি হন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাসুরের ছেলে একেএম ছায়াদত হোসেন বকুল। ওই কমিটিতে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক মাফরুহা হক, অভিভাবক জাভেদ সেলিম ছিলেন। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হওয়ার পর বকুল ২০২২ সালের ১৮ জুন ম্যানেজিং কমিটির সভা করে সিদ্দিকুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পরিবর্তে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অসুস্থ্যতার জন্য ৩ মাসের ছুটি মঞ্জুর করেন এবং সিদ্দিকুর রহমানের নামে মিথ্যা অভিযোগ এনে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহ মোঃ আল আমিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেন। এনিয়ে সিদ্দিকুর রহমান ২০২২ সালের ২৯ জুন এবং একই সালের ৪ আগস্ট প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে চিঠি দিয়ে জানান। এরপরেও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বকুল দায়িত্ব না দিয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে ৭ আগস্ট মিথ্যা অভিযোগ এনে সিদ্দিকুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। এনিয়ে ওই বছর ১০ আগস্ট সিদ্দিকুর রহমান তার বিরুদ্ধে অনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বকুলের কাছে অনুরোধ করলে সেই অনুরোধও গ্রহণ করেনি তিনি। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বকুলের অনৈতিক কর্মকান্ড ও বেআইনীভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা এবং ন্যায্য অধিকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব না দেওয়ায় সিদ্দিকুর রহমান বরখাস্ত আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় চলতি বছরের ১৫ জুন রংপুর যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক মোঃ হাফিজুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহ মোঃ আলামিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অবলিম্বে সিদ্দিকুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদানের জন্য সভাপতিকে নির্দেশ দেন। ঈদুল অযাহার ছুটি’র পর রবিবার (৯ জুলাই) সকালে স্কুলে গিয়ে সিদ্দিকুর রহমান দেখেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্দেশে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান এটি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বলতে পারবে। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বকুলকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সিদ্দিকুর রহমানের ফোন রিসিভ করেননি। কক্ষ তালাবদ্ধ থাকায় সিদ্দিকুর রহমান দিনভর বিদ্যালয়ে থেকে বাড়ি ফিরে যান।


ভুক্তভোগী শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন। তারা সাময়িক থেকে পূর্ণাঙ্গ বরখাস্তের পরিকল্পনা করেছিলেন। ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে আমি আদালতের স্মরণাপন্ন হলে আদালত অবিলম্বে আমাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সভাপতিকে নির্দেশ দেন। ঈদুল আযহার ছুটি শেষে আমি স্কুলে এসেও আমার দায়িত্ব বুঝে পেলাম না। এদিকে ঐতিহ্যবাহী এ স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ নেই। সভাপতি তার খেয়াল খুশি মত বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর আমি অবসরে চলে যাব। আমি আমার ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে চাই।     
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে জটিলতা চলছে। আমি চাই আদালতের রায় বাস্তবায়ন হোক। সিদ্দিকুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক করা হোক।  
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন সরকার বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদটি পাওয়ার দাবীদার সিদ্দিকুর রহমান। আদালত তার পক্ষে রায় দিয়েছে শুনেছি। এটি বাস্তবায়ন করবে ম্যানেজিং কমিটি, আমাদের শিক্ষকদের করার কিছুই করার নেই। 
এ ব্যাপারে একেএম ছায়াদত হোসেন বকুল বলেন, এ বিষয়ে আমার একার করার কিছুই নেই। আমি শিক্ষকদের সাথে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।