রংপুরে ধু-ধু বালুচরের বুকে স্বপ্ন বুনছে কৃষক
মেরিনা লাভলী ♦ উজানের পাহাড়ী ঢল আর বৃষ্টির বিদায়ে শুকিয়ে গেছে রংপুরের তিস্তা নদী। পড়েছে বিশাল ধু-ধু চর। গেল দু’মাস আগে যে নদীর বুকে নৌকা চলতো এখন সেখানে স্বপ্ন বুনছেন কৃষক। তাদের আশা চরের বালু মাটিতে ফলবে সোনার ফসল। ঘুরবে তিস্তার ভাঙ্গনে নিঃস্ব হওয়া মানুষের ভাগ্যের চাকা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রংপুরের তিস্তা নদী বেষ্টিত গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া উপজেলায় ৯ হাজার ৮৫০ হেক্টর আয়তনের চর রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর চরের জমিকে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। রবি মৌসুমে চরে ভুট্টা, গম, পেঁয়াজ, রসুন, শাক-সবজি, আলু, তামাক, মিস্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
গঙ্গাচড়া মহিপুর শেখ হাসিনা সেতু এলাকায় সরেজমিনের দেখা যায়, তিস্তা নদীর বুকে বিশাল চর জেগেছে। নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে সেতুর দক্ষিণ অংশ দিয়ে। নদীর বুকে পড়ে রয়েছে নৌকা। যা বর্ষা মৌসুমে গোটা নদীতে দাপিয়ে বেড়াতো। এখন কাক ডাকা ভোর থেকে ব্যস্ততা বাড়ে তিস্তা নদী এলাকার কৃষকদের। বিশাল তিস্তার বুককে সবুজে ভরিয়ে দিতে সন্ধ্যা অবধি চলে ফসল চাষাবাদের নানা আয়োজন। কেউ লাঙ্গল চালিয়ে কেউবা ট্রাক্টর দিয়ে চরের ভেজা মাটির বুক নরম করে চাষ উপযোগি করছেন।
খাদ্য উৎপাদনের মহাযজ্ঞ চলছে চরেই। করোনাকালে খাদ্য সংকট না থাকার কৃতিত্বে অংশীদার হিসেবে চরের এসব কৃষককে দেখছেন কৃষিবীদরা। মাথার ঘাম পায়ে ফলে চরের কৃষকরা ফসল উৎপাদন করলেও লাভের গুড় খেয়ে ফেলেন ফড়িয়ারা। তাই উৎপাদিত ফসল বিপণন এখনও চিন্তার কারণ কৃষকদের। তবে কৃষি বিভাগের সহযোগিতার আশ্বাস আশার আলো জ্বেলেছে চরের কৃষকদের মনে।
তিস্তা নদীর দক্ষিণ অংশে তীর ঘেঁষে রসুন-পেঁয়াজ ক্ষেত করেছেন বিজয় বাঁধের আলেয়া বেগম (৪৫)। ক্ষেতের ফসলকে হাঁস-মুরগি থেকে রক্ষায় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাকে।
আলেয়া বেগম বলেন, নদীর পাড়োত আবাদী জমি ছিল, প্রত্যেক বছরোত ম্যালা ধান হইছিল। গোলা ভরা ধান সারা বছর ধরি বাড়ি শুদ্ধায় খাসনু। নদী সউগ নিয়া গেইছে। এল্যা নদী শুকি গেইলে পিয়াজ-অসুন আবাদ করি, মিস্টি কুমড়া নাগামো। এইটা বিক্রি করি সারা বছর চলমো হামরা।
পূর্ব মহিপুর এলাকার আইয়ুব আলী (৬২) বলেন, নদী ভরাট হয়ে গেছে। আলু, মিস্টি কুমড়া চরের জমিতে লাগাচ্ছি। ৭ বিঘা জমিতে ২৮ বস্তা আলু লাগিয়েছি। এই আগাম আলু’র বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে। আলুর পর বাদাম লাগাবো। এভাবে চরে ৬ মাস ফসল আবাদ করে বর্ষার ৬ মাস বসে খাই।
একই এলাকার অপর কৃষক আলমগীর হোসেন (৫৬) বলেন, চরে মিস্টি কুমড়া, এসকোয়াস, লাউশাক, লালশাক, আলু, পেঁয়াজ-রসুন লাগিয়েছি। তিস্তায় পানি আছে। তাই আলু ক্ষেতে সেচ দিতে সমস্যা হচ্ছে না। প্রতি বছর চরে মিস্টি কুমড়া ভালো হলেও ক্রেতা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। এবার যদি সরকার মিস্টি কুমড়া ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয় তবে আমরা চরের মানুষ অনেক উপকৃত হবো।
কৃষিবীদ ও শিক্ষক আহসান হাবীব বলেন, যদি চরের কৃষক না বাঁচে তবে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ এ দেশে খাদ্য সংকটের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই এসব কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চরে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ, উন্নতমানের বীজ প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, সেচ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সরওয়ারুল হক বলেন, রংপুরের জেলায় কয়েকটি নদী বেষ্টিত উপজেলার চরগুলোতে চাষাবাদ হয়। আমরা চরের সব জমিকে চাষের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন চরের কৃষকদের সেচ সুবিধা দিতে সেচ কার্যক্রম নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে।
আমরা কৃষকদের প্যাকেজের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ সুবিধা দেবে। এতে করে কৃষি বিভাগ ও কৃষকদের কর্মতৎপরতায় ধু ধু বালু চরকে সোনার মাটিতে পরিণত করতে পেরেছি। এছাড়াও চরের কৃষকদের মাঝে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্প্রসারণ বেগবান করতে কাজ করা হচ্ছে।