মা ছাড়া অভাব নেই রেজিয়ার সন্তানদের সংসার

মা ছাড়া অভাব নেই রেজিয়ার সন্তানদের সংসার

স্টাফ রিপোর্টার ♦ সুখ আর স্বাচ্ছন্দে দিন কাটছে রেজিয়া বেগমের দুই সন্তানের। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অনেকের মত প্রাণ গেছে রেজিয়ার। মা হারা এতিম সন্তানদের নিয়ে যখন পরিবার দিশেহারা, তখন মানবিক প্রধানমন্ত্রী পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের। তাই গর্ভধারিনীকে হারালেও রেজিয়ার দুই সন্তান হারুন-অর-রশিদ ও নুরুন্নবীর দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তাদের সংসারে এখন অভাব বলতে কিছু নেই। ক্ষেত-খামার করে নিজ বাড়িতে পরিবার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করছেন রেজিয়ার সন্তানরা। 

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন এক লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিলে রেজিয়া বেগমের দু’সন্তানকে নিয়ে তার বাবা নিজ গ্রাম রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার গঙ্গানারায়ন এলাকায় চলে আসে। সেখানে ওই টাকা দিয়ে ২৪ শতক জমি কিনে রেজিয়ার বড় ছেলে হারুন-অর-রশিদকে ৩ শতক, প্রতিবন্ধী ছোট ছেলে নুরুন্নবীকে ৯ শতক ও রেজিয়ার বাকী ৩ বোনকে ৩ শতক করে লিখে দেয় রেজিয়ার বাবা। এরপর প্রধানমন্ত্রী দফায় দফায় মোটা অংকের অর্থ সহায়তা দেয় রেজিয়ার দু’ছেলেকে। এতে পরিবর্তন হয় রেজিয়ার ছেলেদের জীবন।  

সরেজমিনে দেখা যায়, গত ২ বছর আগেও রেজিয়ার ছোট ছেলে প্রতিবন্ধী নুরুন্নবীর খুপড়ি টিনের চালের বাড়ি ছিল। খড়ের ঘরে দেশি গরু পালন করতেন তিনি। ভঙ্গুর বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাড়ির পাশে রাস্তা দেখা যেত। ঘরের খুঁটিগুলোও ছিল নড়বড়ে। সেই বাড়ির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী দেয়া আর্থিক অনুদান থেকে কেনা ৯ শতক জমির শেষ সীমানা ঘেঁসে বড় আধাপাকা উন্নতমানের গরুর ঘর তৈরী করেছেন নুরুন্নবী। ঘরে গরু-লালন পালনের আদর্শ অবকাঠামো করেছেন। তার খামারে ৬টি উন্নতজাতের গরু রয়েছে। নুরুন্নবীর বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি চষে বেড়াচ্ছে। গরুর আধাপাকা ঘর ছাড়াও আরও ৩টি টিনের ঘরে তৈরী করেছেন তিনি। একটিতে স্ত্রীসহ নিজে থাকেন, অপরটি ছেলে জন্য। আরেকটি রান্না ঘর করেছেন। সেই রান্না ঘরে জ্বালানীর জন্য মাচায় খড়ি ভর্তি, কয়েকটি শিকেয় মাটির হাড়ি ঝুলছে।

অনুদান হতে পাওয়া মোটা অংকে টাকা ব্যাংকে রেখেছেন নুরুন্নবী। সেই টাকার সুদ, গরুর দুধ, গোবর, হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে আয় ছাড়াও প্রতিমাসে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন নুরুন্নবী। তার একমাত্র ছেলে মাসুদ রানা (১৪) স্থানীয় বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ছে। নুরুন্নবীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম গরু লালন-পালনে দিনভর ব্যস্ত সময় পাড় করেন।

অপরদিকে নুরুন্নবীর বড় ভাই হারুন-অর-রশিদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম আরাজি শাহবাজপুরে ৩ শতক জমির উপরে বাড়ি ছিল। একই গ্রামে গেল বছর তিনি বাড়ি লাগোয়া আরও ৯ শতক জমি কিনে বাড়ি ভিটা বড় করেছেন। জমি বন্ধক নিয়েছে চাষবাদ বাড়িয়েছেন। তার সংসারেও অভাব নেই। একমাত্র মেয়ে হালিমা খাতুনকে (২৫) বিয়ে দেয়ার পর এখন সুখের সংসার তার। কাজ পাগল হারুন ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েন নিজের জমিতে কৃষি কাজে। তাই নিজের গোলা ভর্তি ধানই যোগান দেয় তাদের সারা বছরের খাদ্য। তার উপর ব্যাংক হতে পাওয়া সুদের টাকা প্রতি মাসে হাতে আসছে তার।  

রেজিয়ার ছোট ছেলে নুরুন্নবী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার নানার হাতে এক লাখ টাকা তুলে দিলে গ্রামে ২৪ শতক জমি কিনে বাড়ি করা হয়। এখানে আমাকে ৯ শতক, আমার বড় ভাইকে ৩ শতক ও আমার ৩ খালাদের নামে ১২ শতক লিখে দেয় আমার নানা। এরপর ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দুই ভাইকে ৪ লাখ করে ৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী আরও ১২ লাখ করে দু’ভাইকে ২৪ লাখ টাকা দেন। ওই টাকা ব্যাংকে ফিক্সড করেছি। ব্যাংক থেকে প্রতি মাসে মাসে টাকা পাই। সেটা দিয়েই সংসার চলে। এবার গরুর খামার বড় করেছি। ভালো আয়-উন্নতি হচ্ছে। আমার মা একুশ আগস্টে জীবন দিলেও প্রধানমন্ত্রী নিজ সন্তানের মত আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। 

রেজিয়ার বড় ছেলে হারুনÑঅর-রশিদ বলেন, বাড়ির ধান ও ব্যাংক থেকে টাকা পেয়ে খুব সুখেই দিন কাটছে আমাদের।সরকার আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে, আগামীতেও নিবে এটাই চাই। 
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার স্মৃতি চারণ করে রেজিয়ার ছোট বোন আনোয়ারা বেগম (৪১) জানান, ৪ বোনের মধ্যে রেজিয়া বেগম বড় বোন। আমার বাবা-মা নিয়ে রেজিয়া হাজারীবাগে বাড্ডায় পানির ট্যাংকের কাছে থাকতো। আমার ভাই নাই, বাবা-মা, বোনদের দেখাশোনা সেই করতো। ২০০৪ সালে একুশ আগস্ট বাজার করে এনে রান্না করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল, আমি আওয়ামী লীগের মিছিলে যাচ্ছি। তোমরা থাকো, আমার আসতে বিকাল হতে পারে। এরপর বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলেও আমার বড় বোন বাড়ি ফেরে না। বাবা-মা’র দুঃশ্চিন্তা করতে থাকেন। আমি আশপাশে খোঁজ করতে থাকি। এরই মধ্যে খবর আসে গুলিস্থানে গ্রেনেড হামলায় অনেক মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে। চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। বোনকে পাওয়া যায়নি। পরে হাসপাতালের লাশঘরে গিয়ে দেখি আমার বোনের মরদেহ রাখা হয়েছে। গোটা গায়ে রক্ত ছিল,পায়ের দিকটা অনেক ক্ষতি হয়েছে, লাল রক্ত পড়ছিলো। সরকারী গাড়িতে করে হাজারীবাগে বাড্ডা নগরে জানাজা শেষে আজিমপুর গোরস্থানে তাকে মাটি দেয়া হয়েছে।

এরপর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা চাল নিয়ে আমার বাবা-মাকে দেখতে এসেছিলেন। বাবা-মাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি আমার বোন। তোমাকে এই বৃদ্ধ বাবা-মার দায়িত্ব দিলাম। এনাদের দেখাশোনা করবা। যখন তারা মারা যাবে যা কিছু থাকবে দুই ভাগ করে রেজিয়ার ২ সন্তানকে দিবা, আর এক ভাগ তোমরা ৩ বোন নিবা। তখন এক লাখ টাকা তুলে দেয় প্রধানমন্ত্রী। সেই টাকা দিয়ে গ্রামে জমি কিনে বাড়ি করেছি। রেজিয়ার বড় ছেলেকে ৩ শতক ও প্রতিবন্ধী ছোট ছেলেকে ৯ শতক জমি লিখে দিয়েছে আমার বাবা। আর ১২ শতক আমরা ৩ বোন ভাগ করে নিয়েছি। ভালোই যাচ্ছে দিনকাল। প্রধানমন্ত্রী যা দিয়েছে তাতে সুখেই আছি।