আজও অধরা রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নিয়ে রংপুরবাসীর স্বপ্ন
মেরিনা লাভলী ♦ রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নিয়ে রংপুরবাসীর স্বপ্ন আজও রয়েছে অধরা। যে তেজ ও সাহস নিয়ে রোকেয়া নারীদের এগিয়ে নিতে কঠিন শৃঙ্খল ভাঙ্গতে লড়াই করে গেছেন। সহনশীলতা ও সহ্যশক্তি দেখিয়ে ছিলেন রোকেয়া। আজ সেই রোকেয়ারই স্মৃতিকেন্দ্র ও জন্মস্থান অন্ধকারে। রোকেয়ার দেখানো পথে হেঁটে নারীরা আজ দেশের শীর্ষ পদ দখল করলেও পথপ্রদর্শকের জন্মস্থান-স্মৃতিকেন্দ্র বড়ই অবহেলিত। তাই দিনে দিনে ক্ষোভ বাড়ছে রোকেয়া প্রেমী ও স্থানীয়দের মাঝে। তবে স্মৃতিকেন্দ্র পুরোদমে চালুর আশ্বাস দিয়েই আসছে প্রশাসন।
জানা যায়, বেগম রোকেয়ার জীবন কর্ম সর্ম্পকে গবেষণা, তাঁর গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতি চর্চা এবং স্থানীয় যুবকদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় অধিবাসীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে’র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরে ২০০১ সালের ১ জুলাই এটির উদ্বোধন করেন তিনি। প্রথমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কেন্দ্রটির দায়িত্বভার গ্রহন করলেও ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর স্মৃতি কেন্দ্রটি বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আবার শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়। এরপর আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘ জটিলতায় পড়ে স্মৃতিকেন্দ্রটি। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে এই স্মৃতি কেন্দ্রটি পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সর্বশেষ বাংলা একাডেমিকে হস্তাস্তর করায় বর্তমানে এ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন একজন উপ-পরিচালক, একজন সহকারী গ্রন্থাগারিকসহসহ ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। দীর্ঘদিন পর এক বছর ধরে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে সংগীত ও চিত্রাংঙ্কন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর চলতি বছর মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি বছর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ দিনব্যাপী রোকেয়া মেলার আয়োজন করা হলেও এবার করোনার কারণে তা ভেস্তে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সংরক্ষণের অভাবে রোকেয়ার জন্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ ক্রমেই মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। একটি জানালা ও কয়েকটি পিলার এখন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর রোপন করা জলপাই গাছের নিচে পড়ে রয়েছে জলপাই। প্রতি বছর মেলাকে ঘিরে দেয়াল-গ্রিল রং করা হলেও এবার তা করা হয়নি। রোকেয়া দিবসকে ঘিরে স্মৃতিকেন্দ্রে ঝোপ-ঝাড় পরিস্কারসহ রাস্তাগুলো ঝেড়ে পরিস্কার করা হয়েছে। রোকেয়ার ভাস্কর্যের সামনে আলো বড় লাইট লাগানো হয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্রে কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিতসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করেছে কর্তৃপক্ষ।
নারী উদ্যোক্তা বিউটি বেগম (৩৫) বলেন, সারা বছর অনেক দর্শনার্থী রোকেয়ার জন্মভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্রে এসে জানতে চায় এখানে কি কি রয়েছে। তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। কারণ রোকেয়ার এ জন্মস্থানে বিলীন হয়ে যাওয়া জন্মভিটা ও রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য ছাড়া দেখার কিছুই নেই। দর্শনার্থীরা এসে কোথায় বসবেন তার জায়গাও করা হয়নি।
প্রবীন সাংবাদিক আব্দুস সাহেদ মন্টু বলেন, রোকেয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবী রংপুরবাসীর ছিল। স্মৃতিকেন্দ্রটি জাকজমকভাবে চলবে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম এটি চরম অবহেলিত অবস্থায় আছে। দেয়ালের রং উঠে গেছে, গ্রিলের জং ধরে গেছে কিন্তু সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রোকেয়া দিবসে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে অনুষ্ঠান করে চলে যান। পরে আর কেউ স্মৃতিকেন্দ্র ও রোকেয়ার জন্মভিটার খোঁজ নেয় না। তাই রোকেয়া দিবস সন্নিকটে আসলেও কোন দর্শনার্থীকে দেখা যাচ্ছে না এখানে। প্রশাসনের অবহেলার কারণে রোকেয়াপ্রীতি জাগ্রত হচ্ছে না মানুষের মনে।
অপর দর্শনার্থী মইনুল হক (৪৬) বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্ন শত বছরের একটি পুরার্কীতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। যা বর্তমানে নিশ্চিহ্নের পথে রয়েছে। এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আমরা চাই স্থবির হওয়া স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম আবার চালু করা হোক। রোকেয়ার জন্মভিটা আলোকিত হোক। রোকেয়া চির জাগ্রত থাকুক এবং তার দেখানো পথে আমরা যেন ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারি।
রোকেয়া ভক্ত দুলালের আক্ষেপ :
রোকেয়া ভক্ত রফিকুল ইসলাম দুলাল। পায়রাবন্দে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নিয়ে লড়াই করে যাওয়া অন্যতম কন্ঠস্বর বলে পরিচিত তিনি। রোকেয়ার জন্মভিটার সংলগ্ন ‘পায়রাবন্দ রোকেয়া স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি সংগঠন চালিয়ে আসছেন তিনি। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি রোকেয়াকে নিয়ে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। নারী শিক্ষার্থীসহ পায়রাবন্দের বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে পাঠাগারে বই পড়েন। তার কাছে রয়েছে রোকেয়ার লেখা চিঠিসহ নানা সংগ্রহ।
১৯৩১ সালের ২৬ জুনে রোকেয়ার নিজ হাতে ছাত্রী রাবিয়া খাতুনের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। চিঠিতে রোকেয়া লিখেছিলেন, “সালাম পর আরাজ, শ্রীমতি রাবিয়া খাতুনের পত্রে জানিলাম, যে খোদার ফজলে আরোগ্য লাভ করিয়াছে এবং এখন এখানে আসিতে চাহে। আগামী সোমবার (২৯ শে জুন) স্কুল খুলিবে। দয়া করিয়া মেয়েকে শীঘ্রই লইয়া আসিবেন।”
এছাড়াও তিনি রোকেয়ার বড় ভাইয়ের একটি বইয়ের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়ার সেই ছাত্রী রাজশাহী জেলার বাসিন্দা রাবিয়া খাতুনকে রোকেয়ার জন্মভূমিতে এনে সংবর্ধনাও দিয়েছেন।
পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, মিঠাপুকুর পায়রাবন্দে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরপর তিনবার এসেছেন। এ সময় রোকেয়া অনুরাগীরা মনে করেছিলেন রোকেয়াকে নিয়ে নানা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও রোকেয়ার উপর গবেষনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম চলবে জোরেসরে। এখানে স্মৃতি পাঠাগার, সেমিনার কক্ষ, সংগ্রহশালা, গবেষণাগার, অডিটরিয়াম রয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার নিবেদন, স্মৃতিকেন্দ্রটির কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করা হোক। রোকেয়ার জন্মভিটার ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ, রোকেয়ার দেহবশেষ ভারত থেকে নিয়ে আসা, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় সরকারীকরণ, ও নব নির্মিতব্য ১০ শয্যার হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে বেগম রোকেয়া মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবী জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আল ফারুক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা প্রতিকূলতার পরেও সংগীত, চিত্রাংঙ্কন প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। করোনার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। এছাড়া রোকেয়ার সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করতে নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। আশাকরি সেটি বাস্তবায়ন হলে স্মৃতিকেন্দ্রটি প্রাণ ফিরে পাবে।
উল্লেখ্য, ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর পায়রাবন্দের রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।