রংপুরে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ নানা দূর্নীতির অভিযোগ
মাদ্রাসার জমি পর্যন্ত বন্ধক রেখে অর্থ আত্মসাত করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে
স্টাফ রিপোর্টার ♦ রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাংনী আহমাদিয়া ফাযিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু ছালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ১২ একর জমি বন্ধক রাখাসহ নিলাম ছাড়া প্রতিষ্ঠানের গাছ বিক্রি করে অর্থ পকেটস্থ করা, নিয়োগ বাণিজ্য, এমপিও নীতিমালা ভঙ্গ করা, রেজুলেশন জালিয়াতি, শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করা, নিয়ম বর্হিভ‚তভাবে মাদ্রাসার টাকা খরচ করা, ম্যানেজিং কমিটিতে আস্থাভাজনকে সভাপতি ও মৃত ব্যক্তিকে সদস্য করাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। তথ্য গোপন, ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, জেষ্ঠ্যতা লংঘন করে পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকারিয়াকে সরকারী কোষাগারে উত্তোলিত টাকা ফেরত দিতে চিঠি দিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। জাকারিয়ার এমন দূর্নীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের দাতা পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকরা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, দুদক, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, রংপুর জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ দিয়েছে। তবে অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকারিয়া। মাদ্রাসার দূর্নীতি-অনিয়মের ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মুখোমুখি অবস্থান করছে শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
অনুসন্ধান ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভাংনী আহমাদিয়া ফাযিল মাদ্রাসাটি ১২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। অধ্যক্ষ মোঃ মাকসুদুর রহমান জামেলী অবসরে চলে গেলে ২০১৬ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র শিক্ষক জাকারিয়া প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির ৯ জনের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া-কাগজপত্র দাখিল করে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ দখল করেন। পদ পাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। জাকারিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে ১০ জন শিক্ষকের বেতন বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ৬ জন শিক্ষক তাকে ৪৯ হাজার টাকা আর্থিক সুবিধা দিলে তিনি ওইসব শিক্ষকের বেতন চালু করেন এবং ৫ জন শিক্ষক টাকা না দেওয়ায় তাদের ১০ মাস বেতন-ভাতা আটকে রাখেন। এ ঘটনায় ১১ জন শিক্ষক রংপুর জেলা প্রশাসক বরাবরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকারিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। জালিয়াতি ও দূর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত জাকারিয়া জেলও খাটেন এবং বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। এরই মধ্যে ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক একেএম শাহীন আখতারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পালনকালে তিনি ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জাকারিয়ার এমপিও শীটে ৯নং বেতন কোড থেকে ৬নং কোডে উন্নীত করেন এবং জেষ্ঠ্যতা লংঘন করে জাকারিয়াকে জেষ্ঠ্য প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক পদে সুবিধা দিয়ে রেজুলেশন স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর বিষয়টি জানতে চাইলে শাহীন আখতার চিঠিতে উল্লেখ করেন, তার অজান্তে জাকারিয়া সুকৌশলে নকল সীল তৈরী করে তার স্বাক্ষর জাল করেছে। এরপর জাকারিয়া কৌশলে ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ভারপাপ্ত অধ্যক্ষ একেএম শাহীন আখতারকে সরিয়ে পূণরায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। এবার তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী মাদ্রাসার সকল আয়-ব্যয় ব্যাংকের মাধ্যমে অধ্যক্ষ ও সভাপতি’র যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি এটি অনুসরন না করে মাদ্রাসা ফান্ডের টাকা নিয়ম বর্হিভ‚তভাবে ইচ্ছেমত খরচ করছেন। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ক্ষমতাবলে মাদ্রাসার প্রায় ১২ একর জমি ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা মূল্যে বন্ধক রাখেন এবং মাদ্রাসার ৬ লক্ষ টাকার গাছ বিক্রি করে কমিটির কিছু সদস্যকে নিয়ে টাকা আত্মসাত করেছেন। অপকর্ম ঢাকতে জাকারিয়া তার পছন্দের ব্যক্তিদের ম্যানেজিং কমিটিতে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে ম্যানেজিং কমিটিতে থাকা অভিভাবক সদস্য খলিলুর রহমানের মেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী না হলেও তাকে অভিভাবক সদস্য করা হয়েছে। জাকারিয়া তার সুবিধার জন্য কো-অপ্ট সদস্য হিসেবে ৩ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করা ডাঃ মানস কুমারকে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়েছেন। এছাড়া আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় সভাপতি শিক্ষাবীদ হওয়ার নিয়ম থাকলেও জাকারিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও পার্শ্ববর্তী বেতগাড়া স্কুলের জুনিয়র শিক্ষক ফরিদুজ্জামানকে সভাপতি করা হয়েছে।
দাতা পরিবারের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু ছালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়া ঐতিহ্যবাহী ভাংনী আহমাদিয়া ফাযিল মাদ্রাসায় দূর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। তিনি মাদ্রাসার জমি পর্যন্ত বন্ধক রেখে অর্থ আত্মসাত করেছেন। ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রক্ষায় আমি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছি। এরপরেও জাকারিয়া বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে নিয়ে গেছে। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষক আকবর আলী বলেন, আমি ২০১৮ সালে অবসর গ্রহণ করেছি। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে জাকারিয়া আমার অবসর ও কল্যাণ সুবিধার কাগজপত্র বিনা কারণে আটকিয়ে রেখেছেন এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আমার ১০ মাসের বেতন-ভাতা বিনা কারণে বন্ধ রেখেছিলেন। যা আমি এখনও উত্তোলন করতে পারিনি। বর্তমানে আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু ছালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আমার আগের অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানের জমি বন্ধক দিয়েছিল। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর কিছু জমি বন্ধকী থেকে ছাড়িয়েছি। মাদ্রাসার ১২ একরের মধ্যে ৭ একরের মত জমি এখনও বন্ধক রয়েছে। এটিও ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের যে সমস্ত গাছ বিক্রি করা হয়েছে তা টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়ম অনুযায়ী করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ রাখার বিষয়টি পুরো মিথ্যা। বেতন মঞ্জুরীর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বিধায় এক মাসের বেতন ছাড় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপ-প্রচারের বিষয়টি দ্রæত সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে সকলকে জানিয়ে দেওয়া হবে।