মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা আরশাদ হারুন আজও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন না

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা আরশাদ হারুন আজও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন না

স্টাফ রিপোর্টার ♦ স্বাধীনতার ইতিহাসের স্বাক্ষী মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রবীণ নেতা আরশাদ হারুন। মুক্তিযুদ্ধের একে একে কেটে গেছে ৫৩ বছর। পাক সেনারা বাঙালি জাতির উপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে তৎকালীন সময় যুদ্ধে অংশ নেওয়া নির্যাতিতরা আজও ভ‚লতে পারেনি সেই ভয়াল দৃশ্য। এ যেন এক বিভৎস। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি আজও মনে পড়লে গা শিউরে উঠে এমনটি জানালেন আরশাদ হারুন।

গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ১৯৭১ সালে যখন সারাদেশে পাকসেনারা বর্বরতা চালাচ্ছিলো বাঙালিদের উপর। অনেক নিরীহ বাঙালি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে তৎকালীন সময় ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকসেনাদের মোকাবেলার জন্য বাঙালিকে ঝাঁপিয়ে যেতে বলেন। তৎকালীন সময় মুন্সিপাড়ার বুদ্ধিজীবী জররেজ মিয়াসহ ১১ জনকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে মাহিগঞ্জে দখিগঞ্জ শ্মশানে হত্যা করে। সেই সময় আরশাদ হারুনের বড় ভাই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক স্বাধীনতাকামী মোহাম্মদ আফজাল পাক সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে ভারতে চলে যান। আরশাদ হারুন তার ছোট বোন তাজুন মোর্শেদা ও কামরুন্নাহার ডানার নিরাপত্তার কথা ভেবে মুন্সিপাড়ার বাসা থেকে অন্যত্র সরিয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জিতেন দত্ত ও ন্যাপ নেতা শাহ আব্দুল বারীর সঙ্গে যুদ্ধ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতে রওনা দেন। পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) সীমানা প্রাচীর পার হয়ে পাবর্তীপুর-ভবানীপুর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট জেলা শহরে প্রবেশ করেন। জয় বাংলা থেকে এসেছে জানতে পেরে ভারতীয় কয়েক যুবক তাদের কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) নিয়ে যান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শংকর বোস পার্শ্ববর্তী অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের যুদ্ধের প্রাথমিক শিক্ষা কৌশল শেখান। অস্ত্র ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি চলছিল। ভারতে অবস্থানরত ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী মোঃ ফরহাদ, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও ন্যাপ নেতা পংকজ ভট্টাচার্য। এ ক্যাম্পে ১৮-১৯ জনের দল থাকায় শংকর বোস দল বড় করার জন্য বাংলাদেশ থেকে আরও যুবক আনার জন্য তাদের নির্দেশ দিলে, ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণে কেউ বাংলাদেশে আসার সাহস পাচ্ছিলো না। অবশেষে খোরশেদ লোহানী ও আরশাদ হারুন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভবানীপুর থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পুরো রাস্তা জুড়ে পাকিস্তানী আর্মিরা টহল ছিল। তাদের নজরে পড়লেই গুলি করতো। এমন অবস্থায় তারা বদরগঞ্জের লোহানীপাড়ায় এসে পৌঁছেন। খোরশেদ লোহানী আরশাদ হারুনকে বললেন এখানে রাজাকার ও আর্মিদের তৎপরতা বেশি বিধায় তুমি শঠিবাড়ির আবিরপাড়ায় চলে যাও। তিনি তাদের কথা মতো আবিরপাড়ায় মিলনপুর ইউনিয়নের বালুয়া মাসুমপুরে সহকর্মীর বাসায় অবস্থান নেন। এ সময় খবর পান খোরশেদ লোহানীকে আর্মিরা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। আরশাদ হারুন বলেন, তিনি যদি আমাকে না সরাতেন তাহলে হয়তো আমিও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হতাম। খোরশেদ লোহানী শহীদ হওয়ার কারণে যুব কর্মীদের ভারত নিয়ে যাওয়ার মিশন ব্যর্থ হয়। ফলে তিনি গুড়াতিপাড়ায় আত্মীয়র বাড়িতে এসে আত্মগোপনের পর মুন্সিপাড়ায় চলে আসেন। এসময় কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনীর সদস্য মোক্তার এলাহীর কাছ থেকে থ্রি নট-ফ্রি রাইফেল কয়েক বাক্স কার্টিজ, গোলা-বারুদ নিয়ে  ঠিকাদার আমিনুল ইসলাম আরশাদ হারুনকে রাখতে দেন। তিনি সেগুলোকে ঘরের সিলিংয়ের ভিতরে লুকিয়ে রাখেন। এরই মধ্যে  সাংস্কৃতিক কর্মী নুর ইসলাম ঢালী আর্মিদের হাতে ধরা পড়লে অমানবিক নির্যাতনের কারণে আরশাদ হারুনের চাচাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা মোকাররম পোকার নাম জানালে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে মোকাররমের মুন্সিপাড়ার বাড়ি ঘিরে ফেলে রাতে অভিযান চালায়। সে সময় মোকাররম পোকা ও মোসাদ্দেক হোসেন নন্তু ভারতে প্রশিক্ষন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। ওই রাতে আরশাদ হারুন মোকাররমের ঘরেই ছিলেন। পাকসেনারা ঘরে ঢুকে ‘দারওয়াজা খোলো, দারওয়াজা খোলো’ চিৎকার করে বলতে লাগলো ‘মোকাররম কাহা হ্যায়’। এ সময় তার মা দরজা খুলতেই পাকসেনারা হুরমুর করে ঘরে ঢুকে স্ট্যানগান উঁচিয়ে মোকাররমকে খুুঁজতে থাকে। আরশাদ হারুন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থেকে আল্লাহর নাম যপতে থাকেন। এক সময় পাকসেনারা হারুনকে মোকাররম মনে করলে মোকাররমের মা বলেন, ওর নাম হারুন, মোকাররম কোথায় আছে জানি না। কিন্তু পাক সেনারা তা না শুনেও  মোকাররম মনে করে নির্যাতন চালিয়ে হারুনকে গুলি করতে উদ্যত হলে জ্ঞান হারিয়ে মোকাররমে মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় পরিবারের অন্যান্য ও বাচ্চাসহ সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর বোখারীসহ অন্যান্যরা মনে করেন মোকাররমের মা মারা গেছে। তখন পাক সেনারা বাচ্চাদের জিজ্ঞাসা করেন, ইয়ে কৌন হ্যায় ? বাচ্চারা বলে, ও হারুন ভাই। তখন মেজর বোখারী পাকসেনাদের নির্দেশ দেন ‘উস্কো ছোড় দো’। এতে করে দ্বিতীয়বারের মত প্রাণে বেঁচে যান আরশাদ হারুন। ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় হলে পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হয়ে দেশে এসে পল্টনের জনসভায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিতে বলেন। এ ঘোষণার পর আরশাদ হারুন শঙ্কর বসুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ওই অস্ত্রগুলো জমা দেন। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ যুগ হলেও আজও আরশাদ হারুন মুক্তিযোদ্ধার কোনও স্বীকৃতি পেলেন না। হয়তো এ আফসোস নিয়ে তাকে আজীবন পাড় করতে হবে।