বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে  রংপুর জেলার মডেল সুলতানপুর গ্রাম

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে  রংপুর জেলার মডেল সুলতানপুর গ্রাম

স্টাফ রিপোর্টার ♦ সবুজ-শ্যামল ধানক্ষেত, ছায়া ঘেরা সড়কের ধারে ধারে পুকুর, কাঁচা-পাকা সড়কে অপরুপ সুলতানপুর গ্রাম। সাড়ে ৩’শ বর্গমিটারের ছবির মত এ গ্রামটি রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।  বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) এ গ্রামকে বাল্য বিবাহমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। গত ৬ মাসে এ গ্রামে কোন বাল্য বিবাহ হয়নি। এর ফলে রংপুর জেলায় সুলতানপুর গ্রাম এখন মডেল গ্রামে পরিণত হলো। ইউনিয়ন পরিষদ, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ও গ্রামবাসীর যৌথ উদ্যোগে সুলতানপুরে বাস্তবায়িত হলো এ অনন্য উদ্যোগ। 
দূর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, সুলতানপুর গ্রামের ৯০ ভাগ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। বিগত সময়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, ফসলের ভাল জাত না থাকা এবং উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল থেকে পিছিয়ে ছিল এ গ্রাম। ফলে অনটনের সংসারে কৃষক পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতো। এতে করে পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি, মেয়েদের অল্প বয়সে গর্ভধারণ, বাচ্চা প্রসবে মায়ের মৃত্যু, অপুষ্ট শিশুর জন্মদানসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল গ্রামের পরিবারগুলো। বর্তমানে এ গ্রামের ১৬১টি পরিবারের মধ্যে ১৭টি ধনী, ৩০টি মধ্যবিত্ত, ১১টি নি¤œমধ্যবিত্ত, ৩৭টি দরিদ্র ও ৬৬টি হতরিদ্র পরিবার রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন দূর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদকে সাথে নিয়ে গ্রামে শিশু ফোরাম গঠন করে। এসব পরিবারে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রæপ হিসেবে ১২ থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৯ জন ছেলে ও ২৩ জন মেয়েকে চিহ্নিত করা হয়। শিশু ফোরামের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের বাল্য বিবাহ সম্পর্কে সচেতন করা, অভিভাবকদের এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে জনগণকে হটলাইন নম্বর সম্পর্কে জানানো, সচেতনতামূলক উপকরণ বিতরণ, মাসিক সভার আয়োজন করা, বাড়ি পরিদর্শন, মাসিক প্রতিবেদন তৈরী এবং বাল্যবিবাহ মুক্ত গ্রাম ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শিশু ফোরামের এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বিগত ৬ মাসের কোন বাল্যবিবাহ হয়নি সুলতানপুর গ্রামে। আর এতেই ঘটা করে উৎসবের আয়োজন করে ওয়ার্ল্ড ভিশন। নাচ, গান, বাল্যবিবাহ নিয়ে মঞ্চ নাটক ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে এ উৎসব পালিত হয়। সুলতানপুর গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা বাবলু তালুকদারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান। বক্তব্য রাখেন, মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা রাশেবুল হোসেন, ওয়ার্ল্ড ভিশনের ন্যাশনাল ডিরেক্টর সুরেশ বার্টলেট, সিনিয়র ডিরেক্টর অপারেশন চন্দন জেড গোমেজসহ অন্যরা।  
শিশু ফোরামের সংগঠক তাসফিয়া আক্তার হৃদিতা বলেন, আমরা শিশু ফোরামের সদস্যরা স্বেচ্ছায় এলাকায় জরিপ করে দেখেছিলাম ৩৫ জন শিশু বাল্য বিবাহের ঝুঁকিতে ছিল। আমরা শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকের সাথে কথা বলে বাল্যবিবাহের কুফল বুঝিয়েছি এবং তাদের ছেলে অথবা মেয়ে যে একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে পারবে তা বুঝিয়েছি। এসব শুনে অভিভাবকরা সচেতন হয়েছেন। 
অভিভাবক নিরা বেগম বলেন, আমি অস্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। এরপর অল্প বয়সে গর্ভধারণ করি এবং আমার অসুস্থ্য বাচ্চার জন্ম হয়। আমি পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে প্রসব পরবর্তী অসুস্থ্য হয়ে পড়ি। এনিয়ে আমার সংসারে নানা সমস্যা দেখা দেয়। আমি বাল্য বিবাহের কুফল জেনে এবং নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করে নিজের সন্তানদের ও প্রতিবেশীর কারো সন্তানকে বাল্য বিবাহ দিতে দেইনি।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের ন্যাশনাল ডিরেক্টর সুরেশ বার্টলেট বলেন, সুলতানপুর বাল্যবিবাহ মুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা হওয়ায় এলাকাবাসী সাথে আমিও আনন্দিত। এলাকাবাসী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গণস্বাক্ষরও করেছে। আজ বাল্যবিবাহ মুক্ত গ্রাম হিসেবে যে উৎসব পালিত হলো, তা গ্রামবাসী যেন সারা বছর স্মরণ করে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন।  ভবিষ্যতে আশপাশের এলাকাও বাল্যবিবাহমুক্ত হবে আশা করছি। 
দূর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, বাল্য বিবাহরোধে এলাকার শিশুদের সার্বিক সহযোগিতায় আমরা নানা কর্মসূচী পালন করেছি। সুলতানপুরের বাল্য বিবাহমুক্ত করার মডেল আমার ইউনিয়নের প্রত্যেকটি গ্রামে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো। 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, বাল্যবিবাহ হলে ওই প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষেরা এর কুফলে ভোগে। সুলতানপুর গ্রাম এখন রংপুর জেলার মডেল গ্রাম। এ মডেলকে ছড়িয়ে দিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাবে। বাল্য বিবাহকে প্রতিরোধ করে এলাকার শিশু-কিশোররা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমানে কাজ করবে এই প্রত্যাশা রাখছি। ### ১৪-০৯-২৩ইং