যুগে যুগে নদী থেকে পুকুর প্রমত্তা চাকিরপশার

যুগে যুগে নদী থেকে পুকুর প্রমত্তা চাকিরপশার

মেরিনা লাভলী ♦  চাকিরপশার। কুড়িগ্রামের এক সময়ে প্রমত্তা নদীর নাম। ৩০ বছর আগেও এটি নদীই ছিল। বর্তমান প্রজন্ম রাজারহাটের চাকিরপশারকে চেনে বিল অথবা পুকুর হিসেবে। আশির দশকে সেতু ছাড়াই এ নদীর বুক চিরে তৈরী করা হয়েছে সড়ক। এরপরই শুরু হয়েছে নদীকে বিল এবং বিল থেকে পুকুর বানানোর কাজ। যুগে যুগে মরণ দশা হয়েছে চাকিরপশার।

স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে প্রমত্তা এ নদী আজ মরতে বসেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। চাকিরপশা নদী মরতে বসার কারণে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্রের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদনও। নদীর পাড়ে কমেছে অতিথি পাখির আনাগোনা। এদিকে চাকিরপশা নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে জাতীয় নদীর রক্ষা কমিশন ১২২ জন দখলদারদের চিহ্নিত করে তালিকা করেছে। এ তালিকায় রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সরকারী দলীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবীদরা। ওদিকে আগামী ২৬ ডিসেম্বর চাকিরপশার নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, উজানে জলাবদ্ধতা নিরসন, জেলে ও সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্তকরণ, খনন, ইজারা বাতিল এবং সেতুবিহীন সড়কে সেতু স্থাপনের দাবীতে সমাবেশ করবে  চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি, রিভারাইন পিপল ও গণকমিটি ।

জানা যায়, চাকিরপশার নদীটি তিস্তা নদীর উপনদী। এটি মূলত বুড়িতিস্তা নদীর উজানের অংশ। নদীটির উৎপত্তিস্থল রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ি দোলা নামক নিম্নাঞ্চল থেকে। এ নদীর উজানের লালমনিরহাটের মোস্তফী এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার হাটমল্লিক বেগ, নাটুয়া, পুটিকাটা, দেবীচরণ, দক্ষিণ প্রাণপতি, ইটাকুড়ির দোলা মৌজার নিম্নাঞ্চলের পানি মিলে চাকিরপশা নদীর প্রবাহ তৈরী হয়েছে। চাকিরপশার নদী কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কাঁচকোলে একসময় ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হতো। কিন্তু ২৫-৩০ বছর আগে তিস্তা নদী উত্তর পাড় ভেঙে উত্তরে এগিয়ে এলে এ নদীর অনেকটাই তিস্তার ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রায় ৪০ কিলোমিটা দৈর্ঘ্যরে এ নদীটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে রাজারহাট থেকে চাকিরপশার ২০ কিলোমিটার পর তিস্তার একটি উপ-নদী, অন্যদিকে আরও ২০ কিলোমিটার পর উলিপুরের দিকে চলে গেছে নদীটি। ১৯৮০ সালের দিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান স্থানীয় এক নেতার বাড়িতে যাওয়ার জন্য চাকিরপশা নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এতে করে প্রবাহ বন্ধ হয়ে উজান আর ভাটি দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর চাকিরপশার নদী যেসব মৌজা থেকে পানি নিয়ে নদীতে আসতো সেইসব মৌজার প্রায় ২৫ হাজার একর জমি জলাবদ্ধতার কারণে অনাবাদি থাকছে। এতে করে ৩ ফসলী জমিতে এখন কোন উৎপাদনই হচ্ছে না। নদীর বুকে সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ হওয়ার পর শুরু হয় নদী দখলের মহা উৎসব। 

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজারহাট সদর ইউনিয়নের পাঠানহাটে অন্তত ৪০ একর জমিতে পুকুর করেছেন উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মেজর (অব.) ইউনুছ আলী। ৩০ একর জমিতে বাড়িসহ পুকুর প্রাচীর দিয়ে ঘিরে তিনি গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। পুকুরপাড়ে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ গাছ। দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে গবাদিপশু রাখার একটি শেড এবং একটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, নদীর জমিতে বিশাল খামার তৈরীসহ তাঁর বাড়ির সামনে নদীর ৩ একর জায়গা বালু ভরাট করে বিক্রিও করেছেন তিনি। ইউনুস আলীর দখল করা জমির পূর্ব দিকে প্রায় ৮ একর আয়তনের ২টি পুকুরের মালিক স্থানীয় আহসান হাবীব। তিনি চাকিরপাশা ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান মীর ইসমাইল হোসেনের নাতি ও বিএনপি নেতা হাবিবুল্লাহর ছেলে। এরপরের ৬ একর আয়তনের পুকুরটি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও রাজারহাট উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দীর পরিবারের দখলে রয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।  

নদী দখল প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত ইউনুছ আলীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, এসব জমি আমার কেনা জমি। স্থানীয় লোকজনের কাছে ৪০ একর জমি কিনেছেন। তারপর এসব জমিতে তিনি পুকুর করেছেন। আমার জমি কেনার দলিলপত্র  রয়েছে। 

পাঠানের হাটের নদী পাড়ের বাসিন্দা ওমর ফারুক (৪৫) বলেন, নদীর পাড়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। এক সময় এ নদীর বুকে সারা বছর পানি থাকতো। স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরতো। আমরা নদীতে গোসল করতাম। কতইন না স্মৃতি মধুর ছিল আমাদের শৈশব। এখন নদীর পাড়ি বাড়ি থাকলেও সেই নদীতে নামা যায় না। কারণ পুরো নদী এখন লীজ দেয়া। দখলদাররা নদীর বড় বড় অংশ খন্ড খন্ড করে পুকুর বানিয়ে সেখানে মাছ চাষ করে। অথচ প্রশাসন এদিকে নজরই দেয়নি বরং নদীকে লীজ দিয়েছে। 

নদীপাড়ের বাসিন্দা লিপি বেগম (৩৬) বলেন, চাকিরপশা নদীর পাড়ে বেড়ে উঠেছি। এক সময় নদীতে শাপলা-পদ্ম ফুল ফুটতো। আমাদের বাপ-দাদারাই মাছ ধরতো। কিন্তু এখন নদীর ধারে নামতে পারি না। সরকারী এটির বন্দোবস্তো দিয়েছে। এর ফলে চাকিরপশা নদীকে ঘিরে ৪ থেকে ৫’শ জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কথা জেলেরা কথা বললে তারা নানা রকম ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ প্রকৃত জেলেদের আর কাজে নেয় না। এখন তাদের বড় দূর্বিসহ জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। 

রিভারইন পিপলের পরিচালক ও চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, নদী চেনার জন্য সরেজমিনে যেতে হবে। কাগজে কলমে বিল থাকলে নদী কখনো বিল হয়ে যায় না। চাকিরপশার নদীকে কাগজে কলমে বিল বানানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় দেশে ৪০৫টি নদী রয়েছে। অথচ তালিকাভুক্ত ছাড়া আরও অসংখ্য নদী রয়েছে। যেগুলোর নাম উঠে আসেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নদীর পানি বাধাহীন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের রায় আছে, আইন আছে এমন কি এক বছরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চাকিরপশার নদী সুরক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন বরাবর ছয়বার চিঠি দিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ও চিঠি দিয়েছে। এত কিছুর  পরও নদীর অবৈধ দখল, অবৈধ বন্দোবস্ত এবং জলাবদ্ধতা বজায় আছে। জেলা প্রশাসনের কাজে গতি কম থাকার কারণে এ বছর ২৫ হাজার একর ধানের জমিতে প্রায় ২৫ লাখ মণ ধান উৎপাদন ব্যহত হয়েছে।  হাজার হাজার মৎসজীবী আজ খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। নদী সুরক্ষায় জেলা প্রশাসন কালক্ষেপণ করলে তাদের জবাবদিহিতা জরুরি। নয়তো বাংলাদেশের নদী সুরক্ষা কঠিন। 

চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক খন্দকার আরিফ বলেন, চাকিরপশার নদীটিকে দখল করে অসংখ্য পুকুর তৈরী করায় জলাবদ্ধতার কারণে উজানে প্রায় ২৫ হাজার একর জমি ফসলহীন হয়ে আছে। প্রতি মৌসুমী কয়েকশ কৃষক প্রায় ২৫ লক্ষ মন ধান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং সহস্রাধিক মৎস্যজীবী কর্ম হয়ে আছেন অথচ এত বিপুল মানুষজনের সংকটকে পাত্তা দিচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসন। দু’বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে নি।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, চাকিরপশার কখনই নদী ছিল না, এটি মূলত বিল। এতে অবৈধ ২২ জন দখলদার আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা নিয়ে আইনগতভাবে দখলদারদের হোল্ডিং বন্ধসহ উচ্ছেদ করা হবে। এছাড়া সিএস রেকর্ডসহ এখন পর্যন্ত সব রেকর্ড আইনগতভাবেই সংশোধন হবে। চাকিরপশার উপর একটি ব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। 

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেন বলেন, রংপুর বিভাগের সকল নদ-নদী দখল মুক্ত করতে আমাদের তৎপরতা অব্যহত রয়েছে। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে প্রশাসন সর্বদা তৎপর। আমরা মাঠ পর্যায়ে নদীর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে বিভাগের ৮ জেলার সকল নদীর উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবো।